বিশ্বজয় করেছে কক্সবাজারের কাঁকড়া। এই জেলার বিভিন্ন ঘেরে উৎপাদিত কাঁকড়া এখন বিশ্বের প্রায় বিশটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এখানকার কাঁকড়ার সুখ্যাতি।
চিংড়ি চাষিরা এখন ঝুঁকিমুক্ত নতুন এ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে করে নতুন এ খাত থেকে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। পাশাপাশি বেকারদের জন্যও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান। জানা যায়, কক্সবাজারের প্রায় দেড় লাখ একর জমিতে প্রতি বছর চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে।
কিন্তু হোয়াইট স্পট ভাইরাসসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে চিংড়ি চাষিরা এখন ঝুঁকছেন কাঁকড়া চাষের দিকে। কারণ কাঁকড়া চাষে তেমন রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি থাকে না। তাই এক সময়ের অবহেলিত কাঁকড়া ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিদেশে চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা হচ্ছে কাঁকড়ার চাষ। ফলে উৎপাদন যেমন বাড়ছে তেমনি চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন। উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদনের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের কাঁকড়ার চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইতিমধ্যে কাঁকড়া চাষ ও রপ্তানি করে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার ২০১৬-এ স্বর্ণপদক ও ৫০ হাজার টাকার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন কক্সবাজারের অংছিন। গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন। অংছিন ‘ইরাওয়ান ট্রেডিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারই মতো কক্সবাজারের আরো অনেক চিংড়ি চাষি কাঁকড়ার চাষ করে এখন স্বাবলম্বী।
কক্সবাজার সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ড. মঈন উদ্দিন আহমদ বলেন, নরম খোলস বিশিষ্ট কাঁকড়া উৎপাদন করেন অংছিন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তার উৎপাদিত কাঁকড়ার খামার দেখে উৎসাহিত হয়ে জেলায় শতাধিক ব্যক্তি কাঁকড়া চাষ শুরু করেছেন। বর্তমানে কক্সবাজারের কাঁকড়া চাষিরা অন্তত ২০টি দেশে নিয়মিত কাঁকড়া রপ্তানি করছেন।
অংছিন বলেন, নিজের সঞ্চিত অর্থ ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার-দেনা নিয়ে প্রথমে ৪০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। ওই বছর মৎস্য বিভাগের সহায়তা নিয়ে বিদেশে কাঁকড়া রপ্তানি করার সুযোগ পাই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি জানান, খামারে ৩০ থেকে ৪০ জন ব্যক্তি নিয়মিত কাজ করে। তাছাড়া ৮০ থেকে ১০০ জনের পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে।
মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৩ সালের দিকে প্রথম কাঁকড়ার পোনা ও চাষ বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্র। এরপর ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে ইউএসএআইডির অর্থায়নে ও আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের এ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম অ্যান্ড নিউট্রিশন প্রকল্পের যৌথ তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের একটি হ্যাচারিতে নতুন উদ্যোগে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনে নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করে।
বর্তমানে কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারচড়া, সদরের খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডি, গোমাতলী, উখিয়ার বালুখালী, টেকনাফের লেদা, চকরিয়ার বদরখালী, রামপুর, ডুলাহাজারা, মহেশখালীর সোনাদিয়া ও মাতারবাড়ি এবং পেকুয়াতে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতির কাঁকড়া চাষের মৌসুম শুরু হয় মে মাসে। চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। আধুনিক পদ্ধতির কাঁকড়া চাষ হয় সারা বছরই।
চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী বাজারের কাঁকড়া সরবরাহকারী ছৈয়দ হোসেন জানান, একসময় কাঁকড়া ব্যবসাকে অনেকে ঘৃণা করত। এখন এ ব্যবসা করাটাই যেন সখের।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন জানান, সরকার কক্সবাজার ও খুলনা অঞ্চলে কাঁকড়ার চাষ সম্প্রসারণের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ হলে উৎপাদিত কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, কাঁকড়া ও কুচিয়া রপ্তানি করে গত বছর (২০১৫ সালে) ১৯৯.৩৮ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে বাংলাদেশ।বিবার্তা
পাঠকের মতামত